ইউনিয়ন পর্যায়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বর্তমান সরকারের আমলে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও যথাযথ প্রস্তুতির অভাব সত্ত্বেও এ সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সুফল দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ইতিবাচক লক্ষ্যে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো ২০১৩-১৫ সময়কালে দেশের সাড়ে চার কোটি মানুষকে সেবা দিয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর গবেষণায়ও গ্রাম পর্যায়ে এ সেন্টারগুলো থেকে বিপুল মানুষের সেবা গ্রহণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। টিআইবির উদ্যোগে পরিচালিত ‘নাগরিক সেবায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার : ভূমিকা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে ইউডিসির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাও তুলে ধরা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বচ্ছ ও কার্যকরভাবে ইউডিসি পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে ১১ দফা সুপারিশও করেছে টিআইবি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে দেশে ইউডিসি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সেবা খাতে দুর্নীতি হ্রাস করতে ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ প্রতিষ্ঠানের মানসম্মত সেবা ব্যাহত হচ্ছে অদক্ষ উদ্যোক্তা, অচল যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ইন্টারনেটের ধীরগতিসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে। অধিকাংশ ইউডিসিতে মোডেমের মাধ্যমে সংযোগ থাকায় ইন্টারনেটে রয়েছে ধীরগতি। এর ফলে অনলাইন সেবা বিলম্বিত হচ্ছে। ইউডিসিগুলোর ৯৮ শতাংশে মোডেম, ১৩ শতাংশে সরকারি অপটিক ফাইবার এবং ৫ শতাংশে বেসরকারি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অপর্যাপ্ততায় যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সেবাগ্রহীতাদের সেবা দিতে ইউডিসি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। টিআইবির প্রতিবেদনে ইউডিসি পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নসহ যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করে দেখবেÑআমরা এমনটিই আশা করতে চাই। গ্রামীণ মানুষের ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে ইউডিসি যে ভূমিকা রেখেছে, তা এগিয়ে নিতে এ প্রতিষ্ঠানকে ত্রুটিমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবেÑএমনটিই কাম্য।
প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পারস্পরিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যাংকিং খাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে ডিজিটাল পদ্ধতি। নিমিষেই তথ্য জানতে বা জানাতে পারছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। স্বল্প সময়ে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়াও হয়েছে সহজ। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত প্রসার ঘটায় এবং হাতে হাতে মুঠোফোন পৌঁছে যাওয়ায় জনগণের মধ্যেও ডিজিটাল সেবা পাওয়ার চাহিদা বেড়ে গেছে। অনলাইনের মাধ্যমে যেকোনো পণ্য কেনাকাটার সুযোগ তৈরি হয়েছে ঘরে বসেই। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার মতো জাতীয় পরীক্ষার ফল পাওয়া যাচ্ছে মুঠোফোনে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য মুঠোফোনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারনেটে ফরম সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছে। অনলাইনে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে পাসপোর্টের ফরম গ্রহণ ও জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। সরকারের সব সেবা সংস্থার ফরম নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ওয়েবসাইট। সেখান থেকে মুহূর্তেই সংগ্রহ করা যাচ্ছে যেকোনো ফরম। মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে জনগণের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা এখন নেই। একইভাবে মুঠোফোনে পাওয়া যাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবাও।
দেশের ব্যাংকিং সেবার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু হওয়ায়। বিপুল হারে এটিএম বুথ চালু হওয়ায় জনগণ সপ্তাহে যেকোনো দিন যেকোনো সময় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে। বাংলাদেশে এখন অনলাইন পেশাজীবীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলছে। প্রযুক্তির অনুকূল পরিবেশ ও বাংলাদেশ সরকারের নানাবিধ সুযোগের কারণে এটি করা সম্ভব হয়েছে। এসব অনলাইন পেশাজীবী করমুক্তভাবে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসছেন, যা দেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এ অনুকূল পরিবেশ অব্যাহত থাকলে এগিয়ে যাবে দেশ।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণ করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দেশগুলো প্রযুক্তিতে ব্যবহার করছে নিজ নিজ মাতৃভাষা। চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য এসেছে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মানুষও তথ্যপ্রযুক্তিকে মাতৃভাষায় ব্যবহারের উপযোগী করে নিয়েছে।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে; যার কারণে দূরকে আর এখন দূর মনে হয় না। এমনকি অনেক দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে। জেনে-বুঝে ভালো কিছু গ্রহণ করতে পারছে। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মেয়েদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। আধুনিক যুগের এ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মেয়েরা বাইরে চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঘরে বসেও ফ্রিল্যান্স বা অডিট সোলিংয়ের কাজ করছে। এতে একদিকে কমে গেছে যোগাযোগ খরচ, অন্যদিকে সংসার সামলিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আয় করার সুযোগ পাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও নানাবিধ সেবামূলক কাজ আগের চেয়ে সহজে, দ্রুত এবং কম খরচে অনেক ক্ষেত্রে বিনা খরচে সম্পন্ন করা যায়। শিক্ষা একদিকে যেমন মানুষের জ্ঞানভান্ডারকে পরিপূর্ণ করে, তেমনি অন্যদিকে অর্থনৈতিক দৈন্য এড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। লেখক : চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস